বাংলাদেশের ইতিহাস


বাংলাদেশ শিল্পীর রংতুলি দিযে় আঁকা হাজারো নদীর মোহনায় সবুজের অরণ্যে ঘেরা দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্রায়তন এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এর আয়তন প্রায় ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল বা ১৪৭,৫৭০
বর্গকিলোমিটার এদেশের উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, অরূনাচল আসাম রাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা রাজ্য বার্মা বা বর্তমানে মায়ানমার এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এর কিছু কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে বেশ প্রাচীন হলেও বাংলাদেশ অংশের জনসমাজ কোন পৃথক সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি তবে অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র বিশিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে টিকে ছিল যুগে যুগে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ প্রাচীন ইতিহাসের কোন পর্যায়েই সম্পূর্ণ স্বাধীন একতাবদ্ধভাবে আপন রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুযোগ পায় নি এই সুযোগ তারা লাভ করেছে ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত স্বাধীনতার পর তবে বাংলাদেশের জনসমাজ আবার কখনও কারও সম্পূর্ণ অধীনতাও স্বীকার করে নি অনেক বিদ্রোহের জন্ম হয়েছে এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক কালে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই এই বঙ্গোপসাগরের নিচে চাপা পড়ে ছিল বাংলাদেশের মূল অংশ সাগরের কোল থেকেই জেগে উঠেছে

উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় হাজার বছর আগে ধারণা করা হয় দ্রাবিড় তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল পরবর্তীকালে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন প্রায় একশ বছরের অরাজকতার (যাকে মাৎসন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়) শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয়, এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করে এর পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের হাতে বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ১২০৫- সালের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খীলজী নামের একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান ষোড়শ শতকে মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগে পর্যন্ত বাংলা স্থানীয় সুলতান ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয় মোঘল বিজয়ের পর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর

বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের পর কোম্পানির হাত থেকে বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে ব্রিটিশ রাজার নিয়ন্ত্রণাধীন একজন ভাইসরয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন  ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে বহুবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এর মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লাখ লোক মারা যায়
১৯০৫ হতে ১৯১১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গ আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল, যার  রাজধানী ছিল ঢাকায়  তবে কলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ বুদ্ধিজীবীদের চরম বিরোধিতার ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় ১৯১১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে আবার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হয়, আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয় ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যথা ভারত পাকিস্তান মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে ওঠে যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বাংলা নিয়ে যা বর্তমানের বাংলাদেশ পূর্ব পাস্তিানের ইতিহাস মূলত: পশ্চিম পাকিস্তানীদ শাসকদের হাতে নিগ্রহ শোষণের ইতিহাস যার অন্য পিঠে ছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সামরিক শাসন

১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে ভূমি সংস্কারের অধীনে জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক জনসংখ্যাগত গুরুত্ব  সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই  অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক বিষয়ে  নেয়া নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে পাকিস্তানী প্রভাব স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গীর বিরূদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে  পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা 'কপ'-প্রতিষ্ঠা ছিল  পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দলোনের মাইলফলক পূর্ব পাকিস্তানের  স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসাবে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে, এবং ১৯৬৯ নাগাদ দলটি পূর্ব  পাকিস্তান তথা বাঙালি জাতির প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি দফা আন্দোলনের সূচনা  ঘটে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কারাবন্দী করা হয় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র  মামলায় মাধ্যমে আবার তাঁকে বন্দী করা হয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের সামরিক জান্তার পতন গঠলেও  সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে কারাবন্দীত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে শেখ মুজিব ১৯৭০- অনুষ্ঠিত জেনারেল ইয়াহিয়া প্রদত্ব  প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জ্জন করেন

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেকিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অসহযোগিতা অব্যাহত রাখে১৯৭০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ  করলেও সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় মুজিবের সাথে গোলটেবিল বৈঠক সফল না হওয়ার পর জেনারেল  ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ গভীর রাতে মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসাবে  বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করেপাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হামলাযজ্ঞে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি  ঘটে সেনাবাহিনী তার স্থানীয় দালালদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী প্রায় কোটি মানুষ  শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মোট জীবনহানির সংখ্যার হিসাব কয়েক লাখ হতে শুরু করে ৩০ লাখ  পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের  বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী সরকার গঠন করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলে দীর্ঘ মাস মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশ  সেনাবাহিনী ভারতের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে জয়লাভ করে মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার  কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পন করেন প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানী সেনা  যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরা পড়ে, যাদেরকে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়

 স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রথমে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু হয় শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৩  সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ১৯৭৩ ১৯৭৪ সালে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা  দেয়১৯৭৫ সালের শুরুতে মুজিব দেশে বাকশালের অধীনে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট  সেনাবাহিনীর কিয়দংশ আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ষড়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থানে মুজিব সপরিবারে নিহত হনপরবর্তী মাসে  একাধিক অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতে থাকে, যার সমাপ্তিতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন জিয়া বহুদলীয়  গণতন্ত্র পুনরায় প্রবর্তন করেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে জিয়া আরেকটি  অভ্যুত্থানে নিহত হন ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের পরবর্তী শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ স্বৈরশাসক হিসাবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তার  পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হয় জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী হিসাবে  ১৯৯১ হতে ১৯৯৬ ২০০১ হতে ২০০৬ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ হতে  ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিলেন দরিদ্রতা দুর্নীতির মাঝেও বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র  হিসাবে তার অবস্থান বজায় রেখেছে